তারালাপনির বিয়ে

একটি বিয়ে (আগষ্ট ২০১৯)

শাহ আজিজ
  • ৪৮

তখন চারদিনে ঢাকা- পিকিং চিঠি যেত । আমি চিঠির বাক্স খুলে দেখি তাতে আমার একটি চিঠি আছে , আমার বাগদত্তা স্ত্রী ও প্রেমিকা পাঠিয়েছে । ডাইনিঙে যেতে হাটতে হাটতে খুলে পড়তে শুরু করলাম । তার স্কলারশিপ হয়ে গেছে , এখন আমাদের কি হবে ? মানে আমরা কি ঘর বাধব না কি------- । ঘর সেতো বাধতেই হবে । ডাইনিঙে লাইনে দাড়িয়ে খাবার নিলাম । একাকী বসে খাবার খেলাম আর চিঠিখানি আবারো পড়লাম প্রায় বানান করে । ছাত্রদের ভিড় বেশি না কারন বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র ছাত্রীরা এসে পৌঁছেনি । বিয়ে করব তাও টেলিফোনে , সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম , ঢাকায় যাব তেমন টাকা নেই হাতে , আর যাওয়ার দরকারই বা কেন ? আমি বেশ ভারিক্কিচালে একবোতল বিয়ার নিয়ে আবার বসলাম । চুমুক দিতে দিতে একটা ছক কেটে ফেললাম । কাল দুতাবাসে যাব তারপর একটা ব্যাবস্থা হবে। ডাইনিং প্রায় খালি , আমি বোতলের তলানি টুকু মেরে দিয়ে ভাবলাম আরও একবোতল হাতে ঝুলিয়ে রুমে যাই , আজ বিয়ার খেতে খুব ইচ্ছে জাগছে । একটা বিড়ি ধরিয়ে টেনিস কোর্টের পাশ দিয়ে বাস্কেটবল কোর্টের বিশাল চত্বরে গা ঘেসে পার্ক বেঞ্চে বসলাম । শেষ বিকেল , আকাশ ভরা আলো । আবারো চিঠি খুলে পড়তে বসলাম । আবারো ছোট ছোট চুমুক বোতলে ।
রাতটা বেশ টেনশনে গেল ।
ক্লাস শুরু ১লা সেপ্টেম্বারে । সকালে দুতাবাসে পৌঁছে আড্ডা দিলাম প্রথম সচিবের রুমে । না , এখানে বলা হল না কথাটা । গেলাম রাষ্ট্রদূতের ব্যাক্তিগত সচিবের কাছে । তাকে বললাম তার এই টেলিফোন তো সরাসরি লাইনের , আমায় ব্যাবহার করতে দিতে হবে বিশেষ কারনে , তবে বাইরে থেকে মানে ঢাকা থেকে কল আসবে । সচিব আমার দিকে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে তাকে বললাম পারপাসটা কি। দূত বেল বাজালে তিনি ভেতরে দৌড়ালেন । কিছু বাদেই হাসি মুখে আমায় বললেন রাষ্ট্রদুত আমায় ডেকেছেন । আমি বেশ জড়সড় হয়ে ঢুকলাম । আমার খোজ খবর নিয়ে তারপর বললেন তুমি মেয়ের গার্জিয়ানকে বল মেয়েকে পাঠিয়ে দিতে । আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম । তিনি বললেন আমার গাড়িতে মেয়ে আমার বাসায় আসবে , তুমি বন্ধুদের নিয়ে আসবে নওশা সেজে – হেসে ফেললেন – লজ্জায় পড়ে গেলাম। এখানেই বিয়ে হবে তারপর তোমার বউকে নিয়ে ডরমিটরিতে বা যেখানে খুশি চলে যাবে- রাষ্ট্রদুত খুব মজা পেয়েছেন মনে হল । আরও বললেন শোনো – টেলিফোনের বিয়ে ঠিক আইনসিদ্ধ হয়না , অনেকেই করছে জানি কিন্তু অনেক সময় বউ বদল হয়ে যায় । হা হা করে হাসলেন । আমি তাড়াতাড়ি ভেগে এলাম। বাইরের চত্বরে মাহবুব ভাই , আমাদের সামরিক অ্যাটাচি, আমায় বললেন সব ঠিক তো ? আমি তাকে খুলে বলতেই তিনি হা হা করে উঠলেন , বললেন আমার বাসায় চলে এসো , ওই ফোনেই সব হবে , খানাদানার ব্যাবস্থাতো থাকতেই হবে ।
মাথা থেকে পাথর নেমে গেল ।
ফেরত পথে ইউনিভারসিটির পাশে পোস্টঅফিস থেকে টেলিগ্রাম করলাম , জানিয়ে দিলাম ৫ তারিখ ঢাকা সময় বিকেল ৫ টায় আমায় এই নম্বরে পাবে । সব আয়োজন সম্পন্ন হোক । দুজন আফ্রিকান মেয়ে দুটি বুথ থেকে চিৎকার করে আকাশ বাতাস কাপিয়ে দেশে কথা বলছে । মনে হল তাদের চিৎকার এমনিতেই আফ্রিকার বাসা থেকে শোনা যাচ্ছে । আমি যদি দুতাবাসে না যেতাম তাহলে কাজী সাহেবকে আমার চিৎকার করে আমিন আর রাজি আছি বলতে হত , কি জ্বালা ।
রুমে গিয়ে আমার ভারতীয় রুমমেটের কাছে খবর ফাস করলাম । মালিক জগমোহন তৎক্ষণাৎ উপরে মেয়েদের রুমে গিয়ে খবরটা চালান করে এলো । চলে এলো জেসমিনদার আর অর্চনা লাখেরা । বেশ মজা করে তারা চলে গেল । বিকালে পাকিস্তানি মেয়েরা আমায় শুভেচ্ছা জানাতে লাগলো । ৩ তারিখ পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতারবাদন শুনলাম হলে বসে । গেলাম রেকর্ডিং করা ক্যাসেট নিয়ে সোজা গ্রীনরুমে পণ্ডিতজির কাছে সাইন করাতে । তিনি কপালে চোখ তুললেন এবং বাড়ি বাংলাদেশে জেনে নরম হয়ে বাংলায় কথা বললেন আর দুটি সাইন দিলেন।
খুব খুশীতে ডরমিটরিতে ফিরলাম এবং ভারতীয়দের সাথে চাউল আর ডাল রান্না খেলাম ।
৫ তারিখ । আমার তেমন কোন অনুভুতি জাগছে না যে আজ আমার বিয়ের দিন । ডাক্তারি পড়ছে ইফতেখার আর মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে শামসু যারা আমার সঙ্গে মাহবুব ভাইয়ের বাসায় যাবে । ওরা বিকালের ক্লাস শেষ করে সরাসরি চলে যাবে। আমার নিশ্চয়ই নতুন একটা কাপড় পরা দরকার । সোজা ডাউনটাউনে ওয়াংফুচিং শপিং এলাকায় চলে গেলাম । ২০ কিলো দূর , তিনবার বাস পালটে পায়ে হেটে বাইহুয়াতালউ এর সামনে দাড়িয়ে একটা বিড়ি ধরালাম । ভাবছি কি কেনা যায় ? হুট করে মাথায় এলো মাও কোট মন্দ নয় । তাছাড়া পিকিং এখনও দারিদ্রের সীমানায় রয়ে গেছে , খুব ভাল কাপড় বলতে কিছুই নেই । একসময় কম্যুনিজম ভাল লাগত , ভাল লাগত মাও কোট , তাইই সই। নীল আর বটল গ্রিনে সস্তা আর দামী দুটোই আছে। সস্তা ২ ইউয়ান আর দামী ৫ ইউয়ান , বাংলা টাকায় ২০ টাকা আর ৫০ টাকা মাত্র। বটল গ্রীন পরে ফেললাম , সব ঠিক আছে , দোকানি বলল খুলে ফেল ব্যাগে ভরি , আমি পুরাতন জামা ব্যাগে ভরে আবার বাসস্ট্যান্ডে । এবার জিয়ানগুওমেনওয়েই কূটনৈতিক পল্লীতে ।
ফ্রেন্ডশিপ স্টোরে তিনজন একত্রিত হলাম । এবার মাহবুব ভাইয়ের বাসায় । ড্রয়িং রুমে আরও একজন ভদ্রমহিলা অপেক্ষা করছেন দুই সন্তান নিয়ে । মিসেস মাহবুব আমাদের জন্য চায়ের ব্যাবস্থা করলেন । ভদ্রমহিলা তার কন্যাকে বোঝাচ্ছেন এই হচ্ছে বর , কন্যা জিজ্ঞাসা করল বউ আসবে না ? মহিলা বেশ তৎপর কন্যাকে বোঝাতে যে এই পাগড়ীহীন লোকটাই বর আর বউ ঢাকায় । কন্যা অবাক হয়ে আমায় দেখল কিন্তু তার মনপুত হল না কেননা বরযাত্রী হয়ে আমরা আসিনি , পাগড়ি , গাড়ি ছাড়া কেমুন যেন । টি ভি ট্রলি ঠেলে দিয়ে গেল কেউ একজন । নিচের তাকে ভি সি আর । মাহবুব ভাই চীনা সেনাদের দাওয়াতে । টিভিতে সিনেমা চালু হল “নওকার বিবিকা” । আগে থেকেই সব প্লান করা মনে হচ্ছে । আমি টেলিফোন উঠিয়ে দেখলাম তাতে লাইন আছে কিনা। মিসেস রহমান বললেন ওমা এত ব্যাস্ত , বিয়েতো আমরাও করেছি , আসবে ফোন আসবে , আপনি সিনেমা দেখে কিছু শিখুন , সবাই এবার আমায় নিয়ে হাসাহাসি শুরু করল । ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় ফোন বেজে উঠলো , আমিই ধরলাম , চুপচাপ কিন্তু লাইন আছে বোঝা যাচ্ছে । একজন আমায় বলল নেন ভাই কথা বলেন । আওয়াজ ভালই । আমায় তিনি আমার নাম , পিতার নাম , ঠিকানা বললেন এবং আরও বললেন আমি অমুক এই বিবাহের কাজী অমুকের সহিত এত দেনমোহরানায় বিবাহে রাজি আছি কিনা ? মনে মনে বলি ব্যাটা কাজী এত আয়োজন কইরা এখন জিগাও আমি রাজি কিনা । আমি হ্যা করে দিলাম । ওরা মনে হয় ফোন কেটে দিল কিন্তু আমার যে কথা শেষ হয়নি । ইফতেখার পিকিং ওভারসিজ লাইনে ঢুকে বলল যে লাইনে কথা হচ্ছিল তা আবার দিন, পাওয়া গেল সত্যি। আমি বললাম আমার স্ত্রীকে দিন কথা বলব। মিসেস রহমান হইহই করে বললেন তর সইছে না , এখনি আলাপ হায় হায় , সবাই হাসছে । আমার সদ্য গত হওয়া প্রেমিকা এবং এই মুহূর্তের স্ত্রী আমায় জানালেন খুলনা থেকে কে কে এসেছেন , তার ফ্লাইট কবে , বাড়ি গিজ গিজ করছে গেস্টে । সব হচ্ছে শুধু জামাই নেই ।
ট্রলিতে পোলাও , কোর্মা , টিকিয়া , গরু ভুনা সব নিয়ে হাজির মিসেস মাহবুব। আহা ওনার খুব কষ্ট হয়েছে । বিব্রত হলাম খুব। নওকর বিবিকা দেখা হল না কিন্তু পেট পুরে সুস্বাদু মুগলাই খাবার খেলাম অনেকদিন বাদে । বেশ হইচই করে বেরিয়ে এলাম । রাত ১০ টা বাজে । ভূরিভোজন করে বাসে গেলে অস্বস্তি হবে তাই ট্যাক্সি নিলাম একখানা ফ্রেন্ডশিপ ষ্টোর থেকে । ওদেরকে নামিয়ে আমি আমার ডরমিটরিতে যখন নামলাম রাত ১১ টার বেশি বেজে গেছে । মালিক আমার মাওকোট দেখে আবেগে আবার দৌড়াল ওপরে । খুব দ্রুতই নেমে এলো ভারতীয় আর পাকিস্তানী মেয়েরা। ওরা চা খেতে চাইল । মালিক চা বানাল । কেউ একজন শুকনা ক্যান্ডি আর ফুল নিয়ে এলো । জমজমাট আড্ডা ভাঙ্গল রাত ১.৩০ মিনিটে । আমি আর মালিক বিড়ি ধরালাম , বিদেশি বিড়ি , ষ্টোর থেকে কেনা । আমার এখন কি লজ্জিত বা কুণ্ঠিত হওয়া উচিত না নির্ভয়ে চলা উচিত ভাবছি । বিছানায় কাৎ হয়ে শুলাম সুখটান দিতে দিতে । মালিক আমায় শুধাল বাতাও আজিজ ভাই জিন্দেগী আব ক্যায়সা লাগ রাহি হ্যায় । আমি বললাম নওকার বিবিকা জ্যায়সে ওইছেই লাগ রাহি হ্যায় । হো হো হাসি হাসল মালিক জগমোহন ।
একধরনের অনুভূতিহীন হেমন্তের শুকনা বাতাসে ঘুমিয়ে পড়লাম , কাল সকালে ক্লাস ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাইনুল ইসলাম আলিফ চমৎকার গল্প আজিজ ভাই।আমিতো কল্পনায় বিয়ের খুব কাছেই ছিলাম মনে হচ্ছিল।ভোট রইল।আসবেন আমার পাতায়,তিথির বিয়ে গল্পটি পড়তে।
কাজী প্রিয়াংকা সিলমী মোবাইলের যুগে বসে এই গল্প পড়তে পড়তে চলে গেলাম সেই সময়ে। নিজে এখন দেশের বাইরে পড়াশুনা করছি বলেই মনে হয় ভিনদেশী বা স্বল্পপরিচিত দেশী মানুষের আন্তরিকতাগুলো খুব চেনা মনে হল। তবে আমাদের জন্য দেশের সাথে যোগাযোগটা এখন অনেক সহজ। ভালো লেগেছে পড়তে। অভিনন্দন। আমার লেখা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
নাজমুল হুসাইন বিছানায় কাৎ হয়ে শুলাম সুখটান দিতে দিতে । মালিক আমায় শুধাল বাতাও আজিজ ভাই জিন্দেগী আব ক্যায়সা লাগ রাহি হ্যায় । আমি বললাম নওকার বিবিকা জ্যায়সে ওইছেই লাগ রাহি হ্যায় । হো হো হাসি হাসল মালিক জগমোহন।বেশ লিখেছেন দাদা ভাই।ভোট রইলো।সেই সাথে শুভকামনা।
হা হা হা ধন্যবাদ
প্রজ্ঞা মৌসুমী ফোনেৱ এপাৱে বিয়েৱ ব্যাপাৱটা জানা ছিল, ওপাড়েৱটা জানতাম না। পড়ে বেশ লাগলো। হালকা মেজাজে লেখাটাও বেশ। অত ভাৱিক্কি নেই। আৱ গল্পেৱ নায়ক লেখক নিজে বলেই, বিবাহবাৰ্ষিকীৱ আগাম শুভেচ্ছা
শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ। গল্পের নায়িকা ২ বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । ১৯৮৩ সালের ঘটনা এটি , ২০১৭তে সমাপ্তি ।
রুহুল আমীন রাজু দারুণ লেগেছে গল্প। অনেক শুভকামনা।
ধন্যবাদ , ঘটনাটি আমার নিজের ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

আমার চিরাচরিত প্রথায় বিয়েটা হয়নি হয়েছে ঢাকা - পিকিং টেলিফোনে , বেশ দুর্লভ কিন্তু মজার । সবার এই মজার অভিজ্ঞতা জোটে না । আমার জুটেছে ।

০৮ মে - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৮১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪